আজ আমাদের মেয়ে তাশরিফা রহমান মোসাফ্ফার তৃতীয় জন্মদিন। হাটি হাটি পা করে দুই বছর শেষ করে তিন বছরে পদার্পণ করলো সে। সব কিছুই যেন স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে। এইতো সেদিন তার মা তাকে পেটে নিয়ে হাঁটছে, ঘুরছে, ডাক্তার দেখাচ্ছে, সংসারের যাবতীয় কাজ করছে ইত্যাদি ইত্যাদি সবকিছুই যেন আমার চোখের সামনে ভেসে উঠছে। সত্যি সময়ের উপর কারো হাত নেই।
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারীর ১০ তারিখ। সবশেষ আলট্রাসনোগ্রাফি রিপোর্টে এই তারিখটিই লেখা ছিল। তাই অফিস থেকে একটু তাড়াতাড়ি বের হই। মোসাফ্ফার মা তার বাবার বাড়িতে থাকায় নারয়ণগঞ্জে যাওয়ার পূর্ব মুহূর্তে সেলুনে যাই নিজেকে একটু পরিপাটি করার জন্য। আনুমানিক সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে স্ত্রী ফোন করে লেবার পেইনের কথা জানায়। প্রথমবার বাবা হওয়ার অনুভূতি আর অজানা ভয়ে আমার শরীর তখন কাঁপছিল। কীভাবে বাইক চালিয়ে যাব সেই চিন্তা মুহূর্তেই দূর করে দেয় আমার পরম বন্ধু মামুন। নারায়ণগঞ্জ পৌঁছানসহ সারারাত হাসপাতালে আমার সঙ্গে নির্ঘুম কাটায় সে।
রাত নয়টার দিকে স্ত্রীকে হাসপাতালে নিয়ে যাই। সবকিছু ঠিকঠাক থাকায় ড. আন্টি (খুব কাছের মানুষ) তাকে লেবার রুমে নিয়ে যান। স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় প্রসভের জন্য আমার স্ত্রী শারিরিক-মানসিক যুদ্ধ চালাতে শুরু করে। দেখতে দেখতে রাত শেষ হয়ে ফজরের আজান হয়ে যায়। ড. আন্টি অসাধারণ ধৈর্য্য-ভালোবাসা দিয়ে দায়িত্ব পালন করছিলেন। বর্তমান সিজারিয়ান যুগে তার অবদান কখনই ভুলবনা আমরা। এরমধ্যে আমি নামাজে দাঁড়িয়ে যাই। ঠিক নামাজ শেষ করে সালাম ফেরানোর মুহূর্তেই আমাদের কোলকে আলোকিত করে সুতীব্র চিৎকারের মাধ্যমে মোসাফ্ফা তার আগমনের বার্তা জানিয়ে দিলো পৃথিবীকে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই ড. আন্টি আমার কোলে এনে দেয় মোসাফ্ফাকে। চাঁদের মতো সোনামুখটি দেখে সকল ভয়, দুশ্চিন্তা, নির্ঘুম রাতের জ্বালা মুহূর্তেই উবে গেল কর্পূরের মতো। প্রথম দেখায় যে অনুভূতি হয়েছিল সেটা স্বল্প লেখায় প্রকাশ করা অসম্ভব। এরপর তার কানে মুসলিম রীতি অনুযায়ী আজান দেই।
কেবিনে ঢুকে স্ত্রীকে একেবারে বিদ্ধস্ত অবস্থায় দেখতে পাই। সারারাতের মনোদৈহিক যুদ্ধের ছাপ ছিল চেহারায় স্পষ্ট। মোসাফ্ফাকে তার পাশে শুইয়ে দেওয়ার পর আবেগঘন মুহূর্তটিতে আমরা মা-বাবা দুজনই কান্না সংবরন করতে পারিনি। তবে এ কান্না বেদনার ছিলোনা, ছিল সুখের, সাফল্যের, মাতৃত্ব-পিতৃত্বের গৌরবের।
একটু বলে রাখি, রাতজুড়ে আমার মায়ের উৎকণ্ঠা ছিল মনে রাখার মত। নামাজের বিছানায় বসে নামাজের ফাঁকে ফাঁকে ফোন করে খবর রেখেছেন বার বার। আর শাশুড়ি মা সারারাত মেয়েকে মানসিক শক্তি জুগিয়েছেন পাশে বসে থেকে। মামুনের সঙ্গে একমাত্র শ্যালক ইফাতও আমার নির্ঘুম রাত কাটিয়েছে। একমাত্র ছোট বোনটিসহ ভাইয়া-ভাবিও ঘুমায়নি সেই রাতে। পরিশেষে প্রায় দশ ঘণ্টার উৎকণ্ঠার অবশান ঘটিয়ে আমাদের কাঙ্খিত সন্তান পৃথিবীতে এসে আনন্দের জোয়ার বইয়ে দেয়।
শিয়রে মা বসে থাকার পরও আমার স্ত্রী বারবার আমাকে দেখতে চেয়েছিল। ড. একপ্রকার বাধ্য হয়ে আমাকে ডেকেও পাঠিয়েছেন একবার। মোসাফ্ফার মায়ের সেই মুহূর্তের কথাগুলো হয়তো সারাজীবন আমার মনে তার প্রতি ভালোবাসা বাড়িয়েই যাবে। ওই দিনের সেই অভিজ্ঞতার আলোকে আমি মনে করি, অন্যদের পাশাপাশি স্বামীকে স্ত্রীর পাশে প্রসবকালীন সময়ে থাকা একান্তই বাঞ্ছনীয়।
এখন পুরো ঘর মাতিয়ে রাখে মোসাফ্ফা। আমাদের সকাল-সন্ধ্যা তাকে ঘিরেই কাটে। সুমাইয়া, সোহেলি, জোহামনি, তাহামনি, রাহামনির নয়নের মনি সে। কচি কণ্ঠের মিষ্টি কথায় দাদা-দাদি, নানা-নানীকে মুগ্ধ করে প্রতিনিয়ত। আমার ছোট্ট পরিটাকে দেশীয় সংস্কৃতি আর ধর্মীয় মূল্যবোধের আলোকে এগিয়ে নিতে চাই। পিতার এ মনোবাঞ্ছা পূরণের জন্য পরম করুনাময় আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তার উপর যেন সমস্থ রহমত বর্ষণ করেন। মোসাফ্ফার জন্মদিনে এই আমার বিনীত প্রার্থনা।
( মাহতাব মিনহাজ, সাংবাদিক একুশে টেলিভিশন)