কমলনগর প্রতিনিধি : দিগন্ত জোড়া ফসলের মাঠ। যতদূর চোখ যায় শুধু সবুজ আর সবুজ বিস্তীর্ণ কৃষিজমির অধিকাংশেই দোল খাচ্ছে সয়াবিনের গাছ। এমন চিত্র ল²ীপুর কমলনগর-রামগতি উপজেলার। যাহা ‘সয়াল্যান্ডের রাজধানী হিসেবে খ্যাত’। কম খরচে ভালো উৎপাদনের পাশাপাশি দাম বেশি পাওয়া এঅঞ্চলের চাষিদের অন্যান্য রবিশষ্যের পরিবর্তে তেল ফসলটির আগ্রহ বাড়তে থাকে অঞ্চলব্যাপী। চলতি মওসূমের উঠতি ফসলে মার খেয়ে সেই আগ্রহের মাত্রায় হতাশা ভর করছেন চাষীরা। ফলে একদিকে মারাত্মক ফসলহানি অন্যদিকে কাঙ্খিত মূল্য না পেয়ে চরম দুশ্চিন্তায় সংশ্লিষ্টরা।
উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, ২০২৪-২০২৫ অর্থ বছরে ১২ হাজার ৫শ হেক্টর জমিতে বিভিন্ন পর্যায়ের কৃষকরা সয়াবিন আবাদ করেন। এবারের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে প্রায় ২৭ হাজার ৫০০ মে.টন প্রায়। যার বাজার মূল্য প্রায় ৩ কোটি ৮৫ লাখ টাকা।
জানা যায়, উপজেলার নয়টি ইউনিয়নের চরফলকন, পাটারীরহাট, সাহেবেরহাট, কালকিনি, তোরাবগঞ্জ, চরকাদিরা, চরজাঙ্গালিয়া, চরলরেন্স, হাজিরহাট, চরমার্টিন এলাকায় অধিকাংশ কৃষক তেলজাতীয় এ সয়াবিন আবাদ করেন। বিগত বছরে প্রতি মণ সয়াবিনের স্থানীয় বাজার মূল্য ছিলো ২ হাজার থেকে ২ হাজার ৮০০ টাকা। এবছর আকষ্মিকভাবে বাজার মূল্য নেমে তা দাঁড়িয়েছে মাত্র ১ হাজার থেকে ১ হাজার ৩০০ টাকা করে। এতে বিশ হাজার কৃষক পরিবার দুশ্চিন্তায়।
উপজেলার চরমার্টিন ইউনিয়নের কৃষক মো. ইউছুফ ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, গত বছরের মৌমুমে প্রতি মণ সয়াবিন ১ হাজার ৮০০ থেকে ২ হাজার ৮০০ টাকায় বিক্রি করেছি। এবছর ১ হাজার থেকে ১ হাজার ৩০০ টাকা প্রতি মণ সয়াবিন। যা আমাদের লোকসান গুণতে হবে।
এদিকে স্থানীয় কৃষক সূত্র জানিয়েছেন, তাদের প্রতি হেক্টর জমিতে সয়াবিন চাষে বীজ, সার ও কীটনাশক সহ ব্যয় হয়েছে গড়ে ৩০-৩৫ হাজার টাকা করে। যার উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় ৪০-৫০ মণ। বাজারে এবার সয়াবিনের দাম কম থাকায় এখন বেশিরভাগ বর্গাচাষীদের ‘মাথায় হাত’ অবস্থা হয়ে দেখা দিয়েছে।
সদর হাজিরহাট বাজারের সয়াবিনের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী মো. ফারুক বলেন, আমরা দীর্ঘ দুই যুগ ধরে সয়াবিনের ব্যবসায় করে আসছি। সয়াবিন ক্রয়ে এবছরের মতো লোকসান কখনো হয় নাই। প্রতিমণ সয়াবিনের দাম ১ হাজার থেকে ১২০০ টাকা। যাহা গত বছরের তুলনায় দামে অর্ধেকে নেমেছে। এবছর সয়াবিন কিনে আমরা আড়ৎদারদের দিয়েছি। নগদ টাকা দিয়ে সয়াবিন কিনেছি। ল²ীপুর জেলার রায়পুরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে মাল দিয়েছি। কিন্তু মালের টাকা চাইলে আড়ৎদাররা আমাদের টাকা না দিয়ে উল্টো মাল (বিক্রিত সয়াবিন) ফেরৎ পাঠাবে বলে হুমকি দিচ্ছে। এক পর্যায় আমরা অসহায় অবস্থার মতো। আমাদের ২০০ থেকে ৩০০ মণ সয়াবিন স্টকে। কি করবো; আমরা কিছুই বুঝতে পারছি না। ব্যাংক থেকে নেয়া লোন কিভাবে পরিশোধ করবো। এটা নিয়ে আমরা বড় দুশ্চিন্তায়। তিনি আরও বলেন, আবহাওয়া অনুকূলে না থাকলে সয়াবিনের দাম নেমে পড়তে পারে ৮০০ থেকে ১০০০ টাকায়। একইভাবে কষ্টের কথা বলেন, ব্যবসায়ী মো. সেলিম, আরমান ও নুর উদ্দিনসহ অনেকে। তাদের দাবি ; সরকার যদি সয়াবিনের উৎপাদিত সয়াবিনের দিকে সুনজর না দেন; তাহলে দুই উপজেলার হাজার হাজার কৃষক ও তার পরিবার জীবন ঝুঁকিতে পড়বে। সরকারের উচিৎ সয়াবিনের দাম ন্যায্যমূল্য নির্ধারণ করে দেয়া। তাহলে কৃষকের মুখে হাঁসি ফুটবে এবং সয়াবিন চাষে আগ্রহ হারাবেন না চাষীরা।
বাজারে ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় এবছর উপজেলার মোট সয়াবিনের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হলেও গতবারের তুলনায় কাঙ্খিত দাম না পাওয়ায় আর্থিক লোকসান হবে আনুমানিক ৩-৪ কোটি টাকা।
সংশ্লিষ্টরা জানান, বাংলাদেশে তেলের জন্য সয়াবিন আবাদ সেভাবে সম্ভব না। কারণ ৫ কেজি সয়াবিন বীজ ভাঙিয়ে তেল হয় এক কেজি। আর চার কেজি খৈল বা সয়া কেক হয়। খৈলটা হচ্ছে আসল আর তেলটা বাই প্রোডাক্ট । খৈল থেকে সয়া বিস্কুট, সয়ামিল্ক অনেক কিছুই তৈরি হয়, যাতে প্রচুর প্রোটিন রয়েছে। তবে দেশে উৎপাদিত খৈল কেবল মৎস্য বা প্রাণিখাদ্যে ব্যবহৃত হয়। অন্য দেশের মতো এখানেও সয়া কেকের ব্যবহার বাড়ানো জরুরী । কেননা কেবল তেল দিয়ে পোষাবে না।
কৃষি গবেষকরা বলছেন, ল²ীপুরে সয়াবিনের আবাদ জনপ্রিয় হয়ে ওঠার পেছনে এখানকার অপ্রতুল সেচব্যবস্থারও বড় ভূমিকা রয়েছে। কারণ সয়াবিন আবাদে খুব একটা সেচের প্রয়োজন নেই। ফলে জেলাটিতে এ শস্যের আবাদের উপযোগিতা অনেক বেশি। তা ছাড়া সার্বিকভাবে সয়াবিন উৎপাদন লাভজনক। এটি একটি পরিবেশবান্ধব ফসলও। এতে সারের পরিমাণ লাগে অনেক কম।
স্থানীয় কৃষক সাহাব উদ্দিন, রশিদ ও আবদুল মালেক বলেন, কৃষি কর্মকর্তার ভালো মনিটরিংয়ের আমরা বিনামূল্যে সরকারী বীজ-সারসহ সার্বিক সহযোগিতা ও সুন্দর পরামর্শ পেয়েছি। ভবিষ্যতে আমাদের এমনটা কাম্য থাকবে।
কমলনগর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. শাহীন রানা বলেন, ‘এ বছর কমলনগরে সয়াবিনের উৎপাদন ভালো হয়েছে। কৃষকদের মাঝে উচ্চ ফলনশীল বারি সয়াবিন ৫,৬, বিনা সয়াবিন-৩,৫, বিইউ সয়াবিন-২,৪ ও স্থানীয় সয়াবিন সোহাগসহ জাত উল্লেখ্যযোগ্য। এ ছাড়াও মন্ত্রণালায়ের নির্দেশনা অনুযায়ী সয়াবিন উৎপাদন বাড়ানোর লক্ষ্য নিয়ে আমরা কাজ করছি।’ উৎপাদিত সয়াবিন দিয়ে কী করা হয় জানতে চাইলে তিনি জানান, মাঠ থেকে আহরিত সয়াবিন শুকানোর পর তেলবীজ, ডালবীজ ও পোলট্রি শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে প্রক্রিয়াজাত হয়। পরে সেগুলো রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ করা হয়।
কমলনগর উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. রাহাত উজ জামান বলেন, উপকূলীয় এঅঞ্চলটি সয়াবিনের জন্য বিখ্যাত। ফলে উৎপাদন কাজে কৃষকদের সুবিধার্থে আমরা যে কোন বিষয়ে তৎপর।